চোখ আমাদের শরীরের সংবেদনশীল একটি অঙ্গ। চোখ দিয়েই আমরা পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। তাই চোখের যত্নে কোনো অবহেলা করা যাবে না। চোখে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
চোখের অসুখ নিয়ে বর্তমানে আমাদের কাছে যেসব রোগী আসেন তাদের মধ্যে একটি কমন সমস্যা আমরা লক্ষ্য করছি চোখ দিয়ে পানি পড়া। রোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সারাক্ষণ চোখের পানি মুছতে হয়। বা চোখের পাতাটা সারাক্ষণ ভেজা থাকছে।
চোখ দিয়ে পানি পড়ার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে।
এক. চোখে পানি বেশি তৈরী হচ্ছে;
দুই. যে নালী দিয়ে পানি যায় তা বন্ধ হয়ে আছে।
ফলে পানি জমে যাচ্ছে ও চোখের বাইরে পানিটা উপচে পড়ছে।
চোখে বেশি পানি তৈরি হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- বর্তমানে বায়ু দূষণের কারণে চোখ উঠাটা বেশী হচ্ছে। সেজন্য চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে।
এছাড়া কর্ণিয়াতে যদি কোন আঘাত পেয়ে থাকে বা অ্যালার্জিজনিত কারণেও পানি পড়তে পারে। চোখের পাপড়ি যদি কোনো কারণে ভেতরে ঢুকে থাকে, পাতার ভেতরে যদি ফোলা কিছু থাকে সেক্ষেত্রেও চোখে পানি পড়তে পারে।
এছাড়া যে নালী দিয়ে পানি চলে যাওয়ার কথা সে নালী যদি কোনো কারণে বন্ধ থাকে তা সরু হয়ে যায় তাহলেও পানি বাইরে বেরিয়ে আসে।
শিশু থেকে শুরু করে বড়দেরও এই সমস্যা হতে পারে। সাধারণত এক থেকে তিন মাস বয়সী বাচ্চাদের বাবা মায়েরা আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। বলে চোখের কোণে ময়লা বা পানি জমছে। সেক্ষেত্রে আমরা মায়েদের একটা ম্যাসাজ শিখিয়ে দিই।
ভিডিও দেখুন :
প্রয়োজনে একটা ড্রপ দিই। এদুটো ঠিক মতো করলে চোখ ভাল হয়ে যায়। এরপরও যদি ভালো না হয় তাহলে আঠারো মাস পরে Probing নামক একটা সার্জারি করি।
এই সার্জারীর মাধ্যমে বেশির ভাগ বাচ্চা সুস্থ হয়ে যায়। এরপরও যদি চোখে পানি পড়া সমস্যা থাকে তাহলে তিন-চার বছর বয়সে ডিসিআর নামে একটা অস্ত্রোপচার করি। তখন শিশু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।
আর বড়দের ক্ষেত্রে যদি পানি পড়া রোগটা থাকে তাহলে কিছু টেস্ট করি। এসপিটি নামক কিছু টেস্ট আছে। সেটি করা হয়। পানি পড়ার কারণটা জানা হয়। নালীটা বন্ধ আছে কিনা সেটি দেখা হয়। যদি নালী বন্ধ থাকে সেক্ষেত্রে অপারেশনের দিকে যাই।
কিন্তু কেউ কেউ পানি পড়া সমস্যাটাকে অবহেলা করেন। তারা সেটা নিয়ে বসে থাকেন। এমতাবস্থায় বড় ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। সেক্ষেত্রে চোখের কোনায় পুঁজ জমে। লাল হয়ে যায়। প্রচুর ব্যথা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন অনেকে। পুঁজটা তখন বের করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে দেড় মাস পরে অপারেশনের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি।
চোখ থেকে পানি পড়ে? জেনে নিন করণীয়
===========================
চোখের পানি পড়া রোগে আমরা সকলেই কমবেশী ভুগে থাকি। অক্ষিকোটরের উপরের দেয়ালের সামনে ও বাহিরের দিকে অশ্রু গ্রন্থি অবস্থিত। এই অশ্রু গ্রন্থি থেকে পানি তৈরী হয়ে নালীর সাহায্যে চোখে আসে এবং চোখকে ভিজিয়ে রাখে। বাহিরের ধূলাবালি ও ময়লা যা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ে তা চোখের পানির সাথে মিশে চোখের নাকের দিকের কোণায় আসে। নাকের দিকে চোখের দুই পাতা যেখানে মিলিত হয় তার ঠিক আগে চোখের উপরের ও নীচের পাতায় একটি করে ছিদ্র আছে। এই ছিদ্র দুইটিকে পাংটা বলে। এই ছিদ্র দুইটি দিয়ে চোখের পানি নালী বা ক্যানালিকুলাস-এর সাহাযে নেত্রথলিতে যায়। নেত্রথলি নাকের গোড়ার চামড়ার নীচে নাকের হাড়ের কুঠুরিতে অবস্থিত। নেত্রথলি থেকে পানি নেত্রনালীর সাহায্যে নাকের ভিতর প্রবেশ করে মিলিয়ে যায়।
যদি কোন কারণে অতিরিক্ত পানি তৈরী হয় অথবা পানি তৈরীর পরিমাণ ঠিক আছে কিন্তু নেত্রনালী দিয়ে পানি যাওয়ার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয় অর্থাৎ নেত্রনালী বন্ধ থাকে তখনই সেই পানি চোখ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ে।
চোখ দিয়ে পানি পড়ার কারণসমূহ:
=====================
১.অতিরিক্ত পানি তৈরী হওয়া
২.চোখ উঠলে
৩.চোখে কোন বস্তু বা ময়লা পড়লে
৪.চোখে কোন আঘাত লাগলে
৫.কর্ণিয়াতে ঘা হলে
৬.গ্লুকোমা, আইরিশের প্রদাহ ইত্যাদি চোখের রোগ হলে
৭.বেশী আবেগ প্রবণ হয়ে গেলে।
চিকিৎসা:
======
যে কারণে বেশী পানি তৈরী হয় তার চিকিৎসা করতে হবে।
২. নেত্রনালী বন্ধ হওয়া
(ক) শিশুদের নেত্রনালী বন্ধ হওয়াঃ কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মের পর পরই চোখ দিয়ে সব সময় পানি পড়ে। কখনো কখনো কিছুটা পিচুটি জমে ও চোখ লাল হয়ে যায়। জন্মগতভাবে নেত্রনালী বন্ধ থাকলে এমন হয়। নেত্রনালীর নীচের দিকে একটি পর্দা থাকে। জন্মের পর পরই সাধারণত: এ পর্দা ফেটে গিয়ে নেত্রনালী খুলে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই পর্দা ফাটে না। ফলে নেত্রনালী বন্ধ থাকে ও চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
চিকিৎসা: নেত্রথলির অবস্থানে চোখের কোণায় ম্যাসেজ করতে হবে দিনে ৩০-৪০ বার। সেই সাথে চোখে জীবাণু নাশক ফোঁটা দিতে হবে। নেত্রথলির অবস্থানে চোখের কোণায় ম্যাসেজ করলে নেত্রনালীর ভিতরের চাপ বেড়ে যায়। এতে নেত্রনালীর নীচের দিকের পর্দা ফেটে গিয়ে নেত্রনালী খুলে যায়। শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে এতেই রোগ সেরে যায়। এক বছর বয়সের মধ্যে এ চিকিত্সায় রোগ ভাল না হলে প্রোবিং করে নেত্রনালী খুলে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতেও রোগ ভাল না হলে পরবর্তীতে ৩-৪ বছর বয়সে বা তার পরে অপারেশন করার দরকার হতে পারে।
(খ) বড়দের নেত্রনালী বন্ধ হওয়াঃ নেত্রথলিত প্রদাহ বা সংক্রমণ দেখা দিলে পরবর্তীতে নেত্রনালী বন্ধ হয়ে যায়। নেত্রনালী বন্ধ হয়ে গেলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। নেত্রথলির অবস্থানে চোখের কোণায় চাপ দিলে অনেক সময় পুঁজ মিশ্রিত পানি আসে। মাঝে মাঝে চোখের কোণা ফুলে যেতে পারে ও ব্যথা হতে পারে। আবার কখনো নেত্রথলি ফুলে ফোড়ার আকার ধারণ করতে পারে। একে নেত্রথলির ফোড়া বা ল্যাক্রিমাল অ্যাবসেস বলে। এতে চোখের কোণায় ভীষণ ব্যথা হয়্।
চিকিৎনা: প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। নেত্রথলির প্রদাহ থাকলে এন্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয় এবং চোখে এন্টিবায়োটিক ফোঁটা দিতে হয়। ব্যথা থাকলে চোখের কোণায় নেত্রথলির অবস্থানে হালকা গরম স্যাঁক দিতে হয় ও বেদনা নাশক ওষুধ খেতে হয়। নেত্রথলির ফোড়া বা ল্যাক্রিমাল অ্যাবসেস হলে অপারেশনের মাধ্যমে পুঁজ বের করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভের জন্য অপারেশন করতে হয়। অপারেশন দুই ধরণের আছে। একটি হলো ডি,সি,আর বা ড্যাক্রোসিস্টোরাইনোস্টমি। এ পদ্ধতিতে নাকের হাড় ছিদ্র করে নেত্রথলির সামনের অংশের সাথে নাকের পর্দা জুড়ে দিয়ে নাকের সাথে নতুন রাস্তা তৈরী করে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে অপারেশন করলে সাধারণত: চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অপর পদ্ধতি হলো ডি,সি,টি বা ড্যাক্রোসিস্টেক্টোমি। এ পদ্ধতিতে নেত্রথলি ফেলে দেয়া হয়। অতি বৃদ্ধ বয়সে এ পদ্ধতিতে অপারেশন করা হয়। নেত্রথলি ফেলে দিলে চোখ দিয়ে একটু একটু পানি পড়বে। তবে চোখের কোণা ফুলবে না বা ব্যথা হবে না ও চোখ দিয়ে পুঁজ বের হবে না।
লিখেছেন :ডাঃ চন্দ্র শেখর মজুমদার
সহযোগী অধ্যাপক
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতাল
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা